মুন্সীগঞ্জের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মূল কালণ ৫টি সিমেন্ট কারখানা ও পুকুর ভরাট প্রতিযোগিতা

Spread the love

সুমাইয়া আক্তার সাদিয়া, মুন্সীগঞ্জ

মুন্সীগঞ্জে নদী তীরবর্তী এলাকা ঘিরে গড়ে উঠেছে সিমেন্ট উৎপাদনকারী একাধিক কারখানা। এ সব কারখানা পরিবেশ দূষণ করেই চলছে। ফলে হুমকির মুখে রয়েছে মুন্সীগঞ্জের জনজীবন। চরমোক্তারপুর এলাকার সাধারণ মানুষের জীবন শতভাগ ঝুকির মধ্যে রয়েছে। নারী ও শিশুরা আরো বেশী ঝুকির মধ্যে রয়েছে। এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের নজর দেয়া উচিত বলে মনে করছেন সচেতন মহল। বৃহস্পতিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছের চরমুক্তারপুরে ৫টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরী অনবরত পরিবেশ দূষণ করে চলেছে। ঐতিহ্যবাহী ধলেশ্বরী নদীটির বহু জলজ প্রানীগুলোর অবস্থাও এখন বিপন্ন। সেিমন্ট ফ্যাক্টরী’র প্রভাবে এখানে হলুদ বৃষ্টির ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে।

বায়ু দুষেন আশপাশের জমিজমার উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। গাছপালাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শাহ্ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, ক্রাউন সিমেন্ট, আল্ট্রাটেক সিমেন্ট (পুরনো নাম আমিরাত সিমেন্ট) ও মেট্রোসেম সিমেন্ট গড়ে উঠেছে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার তীর ঘেষে। এই দুটি নদী শেষ করেই ফেলবে এরা।

পূর্ব-পশ্চিম মুক্তারপুর, হাটলক্ষীগঞ্জ, নয়াগাঁও এলাকার মানুষজন সিমেন্ট কারখানার খুব কাছে হওয়ায় তারা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। নদীর পাড়গুলোতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বৃক্ষরোপণ করলেও তা দূষণের তুলনায় অনেক কম। খোলা ক্রেনে করে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে খালাস হচ্ছে ক্লিংকার। বয়লারের চিমনি থেকে ধোঁয়া আকারে বের হয়ে আসছে ফ্লাইঅ্যাশ, যা বাতাসের সঙ্গে মিশে দূষিত করছে আশপাশের পরিবেশ। পাশাপাশি নামি দামী পুকুরগুলোও ভরাট করে ফেলছে ভূমিদস্যুরা। ফলে মুন্সীগঞ্জের পরিবেশের ভারসাম্য আরো হারিয়ে ফেলছে। পায়ো:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা আরো দুর্বল। মশার উপদ্রব বেড়েই চলছে।

সিমেন্ট ফ্যাক্টরিগুলোর লোডিং-আনলোডিং হয় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে হয়। যদি ইনডোর আনলোডিংয়ের মাধ্যমে করে এবং ডাস্ট কালেক্টর সিস্টেম রেখে নিয়মিত পানি স্প্রে করা যেত তাহলে দূষণ অনেকাংশে কমে যেত।

মুন্সীগঞ্জের ড্রেনেজ সিস্টেম পরিবেশ বান্ধব না হওয়ার কারণে সিমেন্ট কারখানার বর্জ্য নদীতে গিয়ে পড়ছে। ফলে নদীর আশপাশের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। প্রত্যেক জেলা শহরগুলোতে যদি বাস্তবায়ন হতো তাহলে শহরের বর্জ্য পরিশোধিত হতো। নদী দূষণ এবং বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থায় অবহেলার জন্য বিভিন্ন সিমেন্ট ফ্যাক্টরিকে অনেক সময় ভ্রাম্যমাণ আদালত জরিমানা করেছে। জরিমানার পরও সতর্ক হয়নি কারখানা কর্তৃপক্ষ।

সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পাশেই রয়েছে প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এখানে প্রায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। ফ্যাক্টরিগুলোর পরিবেশ দূষণের ফলে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিসহ নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

এইচ এস.সির একজন শিক্ষার্থীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সিমেন্ট কারখানার কালো ধোঁয়ায় মাথা ব্যাথা, শ্বাস কষ্টসহ আমাদের নানা সমস্যা হয়।

এডভোকেট মজিবুর রহমান জানান, প্রায়ই কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ভেতরের পরিবেশ এতটাই খারাপ যে প্রশ্বাস নিতেও মাঝে মাঝে কষ্ট হয়। এসব থেকে প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের কোনো ব্যবস্থা নেই।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য নিতে শাহ সিমেন্ট ও প্রিমিয়ার সিমেন্ট কারখানায় গেলে সেখানে দায়িত্বশীল কেউ এ ব্যাপারে গণমাধ্যমে কথা বলতে চাননি।

পরিবেশ অধিদফতরের সিনিয়র কেমিস্ট বলেন, বেশ কিছুদিন আগে আমরা মুন্সীগঞ্জের সকল কারখানা, ফ্যাক্টরি, ইন্ডাস্ট্রির মালিকদের নিয়ে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করি। কাঁচামাল আনলোডের ব্যাপারে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং দূষণ কিভাবে কম হয় তা নিয়ে আলোচনা করি। আমরা জনবল সংকটসহ নানাবিধ সমস্যায় ভুগছি। আশা করি খুব শীঘ্রই এর থেকে আমরা পরিত্রাণ পাব। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা আমাদের পুরোটা দিয়ে কাজ করছি।

মামলা ও জরিমানা করা হলেও থেমে নেই ফ্যাক্টরিগুলো। ছাড়পত্র দেওয়ার ব্যাপারে যাচাই-বাছাইয়ের অভাবে সু্যােগ নিচ্ছে কিছু অসাধু চক্র। কারখানাগুলোর নির্গত পানি যা বছরে চারবার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক তা নিয়েও রয়েছে অনীহা। এছাড়া ফ্যাক্টরিগুলোর পরিবহন ব্যবস্থায় দুর্বলতার কারণে তীব্র যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। অসতর্কতার ফলে সিমেন্ট বোঝাই ট্রলারডুবির ঘটনা অজানা নয়। ২০১৫ সালের ১০ জুন মেঘনা নদীতে ২ হাজার ৫০০ বস্তা সিমেন্ট নিয়ে ট্রলারডুবি এবং এমভি মামা ভাগীনা মুক্তারপুরের ক্রাউন্ট সিমেন্ট ফ্যাক্টরি থেকে দাউদকান্দি যাওয়ার পথে গজারিয়া উপজেলার ইসমানীর চর এলাকার মেঘনা নদীতে ডুবে যায়।

একদিকে যেমন এই অঞ্চলের দূষণের জন্য প্রধান কারণ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, বিভিন্ন কারখানা, ইন্ড্রাস্টি অন্যদিকে এই অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের একটা বড় অংশ এই জায়গায়। তবে অদূর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মুন্সীগঞ্জকে বাঁচাতে এখনই সুদূরপ্রসারী পদেক্ষপ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ।

প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার বস্তা সিমেন্ট উৎপাদনের ধারণ ক্ষমতার এই ৫টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরী লাখ লাখ টন ক্লিংকার জাহাজ থেকে খোলা ক্রেনে করে অপসারণ করছে। এই ক্লিংকারের ডাস্ট উরে গিয়ে পড়ছে নদী, জমি, বাড়িঘরে। মানবদেহের ক্ষতি করছে মারাত্মকভাবে। যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন না করে কর্মরত থাকায় এই সিমেন্ট ফ্যাক্টরীগুলোতে কর্মরত প্রায় চার হাজার শ্রমিক ভুগছেন নানা রোগে।

মুন্সীগঞ্জের অধিকাংশ ডাক্তার জানান, শুধু শ্রমিকরাই নন এই অঞ্চলে বসবাসরতরা ফুসফুসের বিভিন্ন রোগে ভুগছে। মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক ক্লিংকারের ফ্লাই এ্যাশ এ্যাজমা, শ্বাশকষ্টসহ ফুসফুসজনিত নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই ক্রমেই এই অঞ্চলে এই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ সংক্রান্ত শিশু রোগীও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *