কালের সাক্ষী বিক্রমপুর-মুন্সীগঞ্জ

Spread the love

নিজস্ব প্রতিবেদন
মুন্সীগঞ্জ জেলার চারদিকে নদী বেষ্টিত। এই জেলার দক্ষিণে পদ্মা নদী, পূর্বে মেঘনা নদী এবং উত্তরে ধলেশ্বরী নদী। মুন্সীগঞ্জ জেলার নামকরণে বিভিন্ন জনশ্রুতি রয়েছে। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইদ্রাকপুর কেল্লার ফৌজদারের নামানুসারে এই জায়গার নাম ছিল ‘ইদ্রাকপুর’। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় রামপালের কাজী কসবা গ্রামের মুন্সী এনায়েত আলী সাহেবের জমিদারীভুক্ত হওয়ার পর ইদ্রাকপুর মুন্সীগঞ্জ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করে।

নদীবিধৌত মুন্সীগঞ্জের উর্বর মাটিতে অসংখ্য কৃতী সন্তানের জন্ম হয়েছে। এরা হলেন- বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, অতীশ দীপংকর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, গণিতবিশারদ অধ্যাপক রাজকুমার সেন, লেখক ও ভাষাবিদ হুমায়ুন আজাদ, ঔপন্যাসিক শীর্ষন্দু মুখোপাধ্যায়, বাংলার সিংহ পুরুষ চাঁদ, ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী ব্রজেন দাস প্রমুখ।

মুন্সীগঞ্জ এখনও বিক্রমপুর নামে সমধিক খ্যাত। এক সময় এক বিরাট এলাকা নিয়ে গঠিত ছিল বিক্রমপুর। সম্রাট বিক্রমাদিত্যের নাম থেকে বিক্রমপুর নাম হয়েছিল বলে লোকমুখে শোনা যায়। আবার কেউবা বলেন, দ্বিতীয় পাল রাজা ধর্মপালের উপাধি ছিল বিক্রমাদিত্য এবং তা থেকেই এ স্থানের নাম হয় বিক্রমপুর।

চন্দ্রসেন পালদের আমলে বাংলার রাজধানী ছিলো রামপালে। এরই সংলগ্ন মুন্সীগঞ্জ। এখানে রয়েছে ইদ্রাকপুর দুর্গ, বাবা আদমের মসজিদ, কাজী কসবার মসজিদ, মীর কাদিম সেতু ইত্যাদি। মুন্সীগঞ্জ আর রামপালের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কসবা নয়নাভিরাম। সর্বত্রই যেন সবুজে ঢাকা। কাজী গ্রামে গেলে দেখা যায়- একটি প্রাচীন মসজিদ। এরই নাম কাজী কসবার মসজিদ। এটি পনেরো শতকে নির্মিত হয়েছিল।

বিক্রমপুর এক সুপরিচিত ঐতিহ্যমন্ডিত এলাকা, এখনও অনেকে বিক্রমপুরকে নিয়ে গর্ব করেন। বিক্রমপুরের প্রতœতাত্বিক ঐতিহ্যের সাথে জড়িত স্থানসমূহের মধ্যে বাবা আদমের মসজিদ, অতীশ দীপংকরের স্মৃতিস্তম্ভ, ইদ্রাকপুর দুর্গ, হরিশ্চন্দ্রের দীঘি, সোনার মন্দির, পাটপাড়া সতীদাহ মন্দির, রিকাবী বাজারের মসজিদ, বল্লাল সেনের দীঘি, কোদালধোয়া দীঘি উল্লেখযোগ্য।

রাজা হরিশ্চন্দ্রের দীঘি ছাড়াও বিক্রমপুরে ছড়িয়ে আছে আরও অনেক দীঘি। এগুলোর মধ্যে রামায়ণ দীঘি, রামদহ দীঘি, সুখবাসুদের দীঘি, মঘাদীঘি, টঙ্গিবাড়ি দীঘি, ভবগান রায়ের দীঘি, শানের দীঘি, বিশ্বেশ্বর দীঘি, সাগর দীঘি অন্যতম। বিক্রমপুরে আরও রয়েছে- সুখবাসর বাগানবাড়ি, পাটশাহীর পোড়া মঠ, মাকাস পুল, কমলাঘাটের পরিত্যক্ত লোহারপুল, শ্যাম সিদ্ধির মঠ, গোশাল নগরে পালের বাড়ি, ব্রজেন দাসের বাড়ি, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি প্রভৃতি।

বর্মনদের রাজধানী ছিল এই বিক্রমপুরে। পালদের প্রাদেশিক রাজধানীও ছিল এখানে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী অতীশ দীপংকর ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে মুন্সীগঞ্জ জেলার তথা বিক্রমপুর পরগনার ব্রজযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্মৃতিকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য ব্রজযোগিনী গ্রামে তার ভিটায় স্থাপিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। সে সময় প্রখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত অবধূত জেতারির কাছ থেকে তিনি অংক ও ব্যাকরণ শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। এক সময় তিনি চীনে যান। চীনে গিয়ে তিনি যে বিদ্যান ব্যক্তি তা প্রমাণ করেন। সে জন্য চীন সম্রাট অতীশ দীপংকরের পাণ্ডিত্য ও বিজ্ঞতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘অতীব শ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। অতীশ দীপংকর রচিত বহু মূল্যবান গ্রন্থ ইতালির টুপি ও পণ্ডিত হরপ্রসাদ আবিষ্কার করেন।

বিক্রমপুরের আরেক কৃতী সন্তান হলেন জগদীশ চন্দ্র বসু। বিশ্বে স্বীকৃতি অর্জনকারী প্রথম সফল বিজ্ঞানী হলেন তিনি। জগদীশ চন্দ্র বেতার বার্তার পথদ্রষ্টা ও উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে তা তিনি প্রথম প্রমাণ করে গেছেন। তার পৈত্রিক আদি নিবাস বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার রাঢ়িখাল গ্রামে। এই গ্রামে তার বাড়িটি এখন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘর হিসাবে সংরক্ষিত হয়েছে। এ জাদুঘরে রয়েছে ১৭টি দুর্লভ ছবি, জগদীশ চন্দ্র বসুর ওপর উক্তি করা লেখা ও চিঠি। জাদুঘরের ভেতরে শোকেসগুলোর মধ্যে তার স্মৃতি বিজড়িত কিছু ব্যবহৃত বাসনপত্র রয়েছে।

মুন্সীগঞ্জের অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন ইন্দ্রাকপুর দুর্গ। জলদস্যু ও পর্তুগীজদের আক্রমণ থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ সমগ্র এলাকাকে রক্ষা করার জন্য এই দুর্গ নির্মিত হয়। বাংলার সুবেদার ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে মেঘনা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীর সংগমস্থলের পশ্চিম তীরে ইন্দ্রাকপুর নামক স্থানে দুর্গটি নির্মাণ করেন। এটি মোঘল স্থাপত্যের অনন্য সাক্ষী। সুউচ্চ প্রাচীর বিশিষ্ট ইন্দ্রাকপুর দুর্গের প্রতিটি কোণায় রয়েছে একটি বৃত্তাকার বেষ্টনী। দুর্গের মাঝে মূল দুর্গ ড্রামের মতো দেখতে। এখানে দুর্গের মধ্যে শাপলা ফুলের পাপড়ির মতো কিছু ছিদ্র রয়েছে। এক সময় এই ছিদ্র দিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য বন্দুক নিয়ে সৈন্যরা পাহরা দিতো। মূল প্রাচীরের পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে একটি গোলাকার উঁচু মঞ্চ রয়েছে। দূর থেকে শত্রু চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছিল। একটি সুড়ঙ্গ রয়েছে এখানে। জানা যায়, এই সুড়ঙ্গ দিয়ে ঢাকার লালবাগের দুর্গে যাওয়া যেতো। সৈন্যরা তাই করতো-মাঝে মধ্যে এই দুর্গ থেকে লালবাগ দুর্গে তারা চলে যেতেন। সেই কাহিনী এখন শুধুই ধূসর স্মৃতি ছাড়া কিছুই নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *